আত্মপরিচয় ও মানবিক আচরণ
এই শিখন অভিজ্ঞতায় আমরা নিজেদের আত্মপরিচয় সম্পর্কে লিখব। এরপর জোড়ায় বসে পরস্পরের আত্মপরিচয়ের মিল ও অমিল বের করে তালিকা করব। ভৌগোলিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিজ আত্মপরিচয় খুঁজব। বিভিন্ন উৎস থেকে তথ্য নিয়ে ভৌগোলিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট কীভাবে মানুষের আচরণিক রীতি তৈরি করে তা নির্ণয় করব। বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে মানুষের আচরণিক রীতিরে ভিন্নতা শনাক্ত করব। নিজ এলাকার মানুষের ভৌগোলিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে আচরণিক রীতি বৈজ্ঞানিকভাবে অনুসন্ধান করব। অনুসন্ধান থে
কে প্রাপ্ত ফলাফল ও সিদ্ধান্ত প্যানেল আলোচনায় উপস্থাপন করব।
আমাদের সবারই আত্মপরিচয় রয়েছে। আমাদের একটি নাম আছে। একটি পরিবার, এলাকা, সমাজ আছে। আমাদের কিছু ভালো লাগা, খারাপ লাগা আছে। আমাদের স্বপ্ন আছে, বিশ্বাস আছে। আমরা খেয়াল করলে দেখব অনেকের সঙ্গে আমাদের অনেক কিছু মিলে গেলেও কিছু বিষয় থাকবেই যা আমাকে ভিন্ন করে তুলছে। এমনকি একই পরিবারের, একই মায়ের সন্তান হয়েও ভাই-বোনের মধ্যেও ভিন্নতা রয়েছে। আবার একই পরিবারের মানুষের একই ভাষা, পোশাক, রীতি-নীতি, উৎসব উদ্যাপন একরকম হয়। এভাবে ভিন্নতা ও সাদৃশ্যের মেল-বন্ধনে আমরা হয়ে উঠি অনন্য। চলো তাহলে আমরা এখন আমাদের আত্মপরিচয় খুঁজি।
অনুশীলনী কাজ ১: আমরা নিজেদের আত্মপরিচয় লিখি। নিজেদের আত্মপরিচয় লেখার সময় নিচের বিষয়গুলো উল্লেখ করব। |
আমার নাম |
আমার বয়স |
আমার লিঙ্গ |
আমার পূর্বপুরুষ |
আমার পরিবার |
আমার আবাসস্থল |
আমার দেশ |
আমার ভাষা |
আমার পছন্দের খাবার |
আমার পছন্দের গান |
আমার পছন্দের খেলা |
আমার যা করতে ভালো লাগে |
চিত্র: আমার আত্মপরিচয়
আত্মপরিচয় লেখা শেষে আমরা আমাদের যেকোনো একজন সহপাঠীর সঙ্গে নিজের ও তার আত্মপরিচয় নিয়ে আলোচনা করি। এই কাজটি আমরা জোড়ায় করব। আমরা একজন সহপাঠী/বন্ধু বেছে নিই যার সঙ্গে আত্মপরিচয় নিয়ে আলোচনা করব।
জোড়ায় কাজ: আমরা নিজের আত্মপরিচয় ও সহপাঠীর আত্মপরিচয় নিয়ে আলোচনা করে নিচের ছকটি পূরণ করি।
অনুশীলনী কাজ ২: আমার ও আমার বন্ধুর আত্মপরিচয়ের মিল ও অমিল | |
আমার ও আমার বন্ধুর যে পছন্দগুলো একরকম | আমার ও আমার বন্ধুর যে পছন্দগুলো ভিন্নরকম |
দলগত কাজ ১ এখন আমরা ৫-৬ জন করে একটি নতুন দল গঠন করি। দলে আলোচনা করে নিজেদের আত্মপরিচয়ের কোন কোন বিষয়গুলো ভৌগোলিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট নির্ভর তা নির্ণয় করি। আমাদের আত্মপরিচয়ের কোন বিষয়কে আমরা কোন প্রেক্ষাপটের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করব তা জেনে নিই। |
প্রেক্ষাপট | বিষয় |
ভৌগোলিক পরিচয় | ভূ-প্রাকৃতিক অবস্থান ও বৈশিষ্ট্য, আবহাওয়া, জলবায়ু ইত্যাদি |
সামাজিক পরিচয় | সামাজিক অবস্থান, পেশাগত পরিচয়, পারিবারিক পরিচয় ইত্যাদি |
সাংস্কৃতিক পরিচয় | ভাষা, পোশাক, রীতিনীতি, উৎসব ইত্যাদি |
রাজনৈতিক পরিচয় | রাষ্ট্রীয় বা জাতীয় পরিচয়, রাজনৈতিক চেতনা ইত্যাদি |
অনুশীলনী কাজ ৩: ভৌগোলিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে আমাদের আত্মপরিচয় নির্ণয় করে নিচে লিখি।
|
এখন আমরা আরব বেদুইনদের জীবন সম্পর্কে জেনে তাদের আচরণিক রীতি কীভাবে গড়ে ওঠে তা জানব।
আরব বেদুইনদের জীবন
আরব বেদুইনরা মরুভূমির অধিবাসী। তারা মরুভূমির উত্তপ্ত আবহাওয়া ও বালিঝড়ের সঙ্গে সংগ্রাম করে জীবন যাপন করে। তাদের নির্দিষ্ট কোনো আবাসস্থল নেই। মরুভূমির বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়ায়। এ জন্য মরুভূমির সব দুর্গম পথ তাদের জানা। ব্যবসা-বাণিজ্য বা মালামাল পরিবহণে যেকোনো কাফেলার পথপ্রদর্শক তারা। মরুভূমির খেজুরই হচ্ছে তাদের প্রধান খাবার। তারা বিভিন্ন পশু যেমন উট, ভেড়া ইত্যাদি লালন-পালন করে। যেখানেই এই পশুদের খাবারের জন্য জায়গা পায়, সেখানেই তারা সাময়িকভাবে থাকতে শুরু করে।
বেদুইনরা তাদের ঘোড়ায় চড়ে তীব্র বেগে চড়ে বেড়ায় মরুভূমির এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত। তাদের ক্লান্তিহীন অনিশ্চিত জীবন যেন অনেক গতিময়। যে জীবন ছুটছে নতুন কোনো সম্ভাবনার খোঁজে। মরুভূমির অবহাওয়া ও ভূ-প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য তাদের করেছে পরিশ্রমী, উদ্যমী ও বলিষ্ঠ। যদিও আরব বেদুইনরা এখন আর যাযাবর জীবন কাটায় না। তবুও এখনো কেউ কেউ তাদের পূর্বপুরুষদের জীবনযাত্রা, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আচরণের প্রতিফলন পান বর্তমান তরুণদের মধ্যে। এভাবেই ভৌগোলিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট আরব বেদুইনদের আচরণিক রীতি গঠনে ভূমিকা রেখেছে।
আমরা ইতোমধ্যে আরব বেদুইনদের নিয়ে যা যা জানলাম, তার সঙ্গে বই, পত্রিকা, ম্যাগাজিন ইত্যাদি উৎস থেকে তথ্য নিয়ে আরব বেদুইনদের কয়েকটি আচরণিক বৈশিষ্ট্য নির্ণয় করি।
অনুশীলনী কাজ ৪: আরব বেদুইনদের আচরণিক বৈশিষ্ট্য নির্ণয়
|
এভাবে ভৌগোলিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট নির্ভর করে কোনো একটি অঞ্চলে বসবাসরত মানুষের আচরণিক বৈশিষ্ট্যে সাদৃশ্য তৈরি হয়। সাদৃশ্যময় এই আচরণিক বৈশিষ্ট্যগুলো নিয়েই একটি অঞ্চলের আচরণিক রীতি তৈরি হয়। চলো, এখন আমরা বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে আমাদের পরিচয় কিভাবে গড়ে উঠেছে তা জেনে নেয়।
বঙ্গবন্ধু একটি স্বাধীন বাংলাদেশের রূপকার
আমরা জানি ১৯৪৮ সালে ভাষা আন্দোলনের সূচনা হলেও বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থেকেই এই অঞ্চলের মানুষ ধীরে ধীরে জাগছিল। এ আন্দোলনে তরুণ বঙ্গবন্ধু যুক্ত থেকে বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছিলেন। আর বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের সময় তিনি জেলে থাকলেও নেতাদের প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিয়ে গেছেন। ভাষা আন্দোলনকেই বলা যায় স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সোপান। মানে এ থেকেই বাংলাদেশের পথে আমাদের যাত্রা শুরু হলো। তবে তা রাতারাতি হয়নি, একটি মাত্র আন্দোলনেও নয়। তারপর থেকে যুগপৎ রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক আন্দোলন চলেছিল এই সময় থেকে।
ভাষা আন্দোলনের মিছিলে অংশ নেওয়া ছাত্রী ও শিক্ষিকা ভাষা আন্দোলনে জমায়েত সর্বসাধারণ
তখন রাজনীতি অত্যন্ত ঘটনাবহুল কিন্তু জ্যেষ্ঠ নেতাদের মধ্যে একদিকে একাগ্রতার অভাব, সাহস ও ত্যাগের অভাব আর অন্যদিকে নানারকম দোলাচল ও সুবিধাবাদের ফলে ছাত্র-জনতার দুর্বার আন্দোলন সত্ত্বেও দেশ এগোতে পারেনি। দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যেও নিজের জাতীয় পরিচয় নিয়ে সংকট ছিল। সদ্যই তখন ধর্মের ভিত্তিতে ভারত ভেঙে তিন টুকরো হয়েছিল, যার দুই প্রান্তের দুই টুকরা নিয়ে একটি মুসলিমপ্রধান রাষ্ট্র পাকিস্তান এবং মাঝখানের হিন্দুপ্রধান রাষ্ট্র ভারত। যার ফলে অনেককে কেবল ধর্মের কারণে দীর্ঘ কালের আবাসভূমি ছেড়ে দেশ পরিবর্তন করতে হয়েছিল। তখনকার চলমান রাজনৈতিক নেতৃত্বের ভূমিকা নিয়ে বঙ্গবন্ধুও হতাশা প্রকাশ করেছেন। ১৯৫৪-এ ঐতিহাসিক নির্বাচনের মাধ্যমে যুক্তফ্রন্ট সরকার গঠিত হওয়ার পরেও পাকিস্তানি ষড়যন্ত্র থেমে থাকেনি এবং মাত্র অল্প কিছুদিনের ব্যবধানে পাকিস্তান সরকার ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে প্রদেশের নির্বাচিত যুক্তফ্রন্ট সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে। তখন এটি ঠেকানো ও এর বিরুদ্ধে উপযুক্ত রাজনৈতিক পদক্ষেপ গ্রহণে নেতাদের ব্যর্থতার প্রেক্ষাপটে বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত ক্ষোভের সঙ্গে আত্মজীবনীতে লিখেছেন-
'এই দিন থেকেই বাঙালিদের দুঃখের দিন শুরু হলো। অযোগ্য নেতৃত্ব, নীতিহীন নেতা ও কাপুরুষ রাজনীতিবিদদের সঙ্গে কোনো দিন একসঙ্গে হয়ে দেশের কোনো কাজে নামতে নেই। তাতে দেশসেবার চেয়ে দেশের ও জনগণের সর্বনাশই বেশি হয়,
রূপান্তরের কথা
১৯৫৮ সালের সামরিক শাসন তুলে নেওয়া হয় ১৯৬২ সালে। তারপর শুরু হয় ছাত্রদের আন্দোলন। তখনও বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতা ও দলের সমন্বয়ে পাকিস্তানের সঙ্গে অনেক রকম দর-কষাকষি হয়েছে। কিন্তু তাতেও ফল হয়নি। ততদিনে বঙ্গবন্ধু প্রাদেশিক আওয়ামী লীগের সভাপতি। তিনি ১৯৬৬ সালে স্বায়ত্তশাসনের দাবিসহ ছয় দফার ঘোষণা দিলে তারপর থেকে এই বাংলায় সব আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্যমণি হয়ে ওঠেন বঙ্গবন্ধু। পাকিস্তান সরকারও তাঁকেই প্রতিপক্ষ হিসেবে সব সময় জেল জুলুমের মধ্যে রেখেছিল। সে ইতিহাস তোমরা জানো।
এখন আমরা বলব ১৯৭১ সালে বাঙালির রূপান্তর এবং এক বীর জাতিতে উত্তরণের পেছনে বড়ো কারণ হলো উপযুক্ত নেতার সঠিক নেতৃত্ব। বলা যায়, বঙ্গবন্ধুর জাদুকরি নেতৃত্বে সেদিন সব ধরনের বাঙালির রূপান্তর ঘটে এক বীরের জাতিতে। প্রকৃত বীর কেবল লড়াই করে না, প্রয়োজনে সর্বোচ্চ আত্মত্যাগেও প্রস্তুত থাকে। বাঙালি বঙ্গবন্ধুর মধ্যে সেই নির্ভরযোগ্য সাহসী দৃঢ়চেতা নেতাকে পেয়ে, তাদের দেহ-মনে জেগে ওঠে মৃত্যুস্রোত ডিঙিয়ে দেশমাতৃকার স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনার প্রেরণা।
বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙালির কী কী রূপান্তর ঘটেছে তা খুঁজে বের করা জরুরি। কারণ, তা বাঙালির প্রচলিত পরিচয় মুছে দিয়ে এক নতুন ইতিবাচক পরিচয় দাঁড় করিয়েছিল।
সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সম্মেলন
পাকিস্তান সৃষ্টির পরপর ১৯৪৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর ও ১৯৪৯ সালের ১ জানুয়ারি ঢাকায় কার্জন হলে দুইদিনব্যাপী 'পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সম্মেলন' আয়োজন করা হয়। যদিও এর উদ্যোগ নিয়েছিলেন পূর্ব পাকিস্তান সরকারের স্বাস্থ্যমন্ত্রী হবীবুল্লাহ বাহার তবুও এতে অংশগ্রহণ করে ভাষাবিদ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহসহ অনেকেই বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের কোনো রকম ধর্মীয় বিভাজনের বিরোধিতা করেন।
ড. শহীদুল্লাহ ছিলেন সম্মেলনের মূল অধিবেশনের সভাপতি এবং তিনি সভাপতির ভাষণে কয়েকটি দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্য দেন। তখন বাংলা হরফের বদলে আরবি হরফে বাংলা লেখার কথাও উঠেছিল। এ বিষয়ে ড. শহীদুল্লাহ বলেন, আরবি হরফে বাংলা লিখলে বাংলার বিরাট সাহিত্যভান্ডার থেকে আমাদিগকে বঞ্চিত হতে হবে।' এই সময়ে তিনি একটি প্রবন্ধে লেখেন, 'বাংলাদেশের (তৎকালীন পাকিস্তান) কোর্ট ও বিদ্যালয়ে বাংলা ভাষার পরিবর্তে উর্দু বা হিন্দি ভাষা গ্রহণ করা হইলে, ইহা রাজনৈতিক পরাধীনতারই নামান্তর হইবে।' পরবর্তীকালে ১৯৫১ সালের মার্চে চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত হয় 'পাকিস্তান সংস্কৃতি সম্মেলন', ১৯৫২ সালের আগস্টে কুমিল্লায় অনুষ্ঠিত হয় 'পূর্ব পাকিস্তান সাংস্কৃতিক সম্মেলন', ১৯৫৪ সালের এপ্রিলে ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয় 'পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সম্মেলন', ১৯৫৭ সালে টাঙ্গাইলের কাগমারীতে মূলত তৎকালীন আওয়ামী লীগের সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত হয় সাংস্কৃতিক সম্মেলন।
এসব সম্মেলন এবং ১৯৬১ সালে সামরিক শাসন উপেক্ষা করে ঢাকা, চট্টগ্রামসহ সারা দেশে আয়োজিত রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী সারা প্রদেশের শিক্ষিত মানুষ ও ছাত্র-তরুণদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলেছিল। চট্টগ্রাম ও কুমিল্লার সম্মেলনে প্রধান অতিথির ভাষণে বর্ষীয়ান গবেষক ও পুঁথি সংগ্রাহক আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ বাঙালির অসাম্প্রদায়িক মানবিক ঐতিহ্য এবং সাহিত্য ও সংস্কৃতির উদার মানবিক ধারার কথা ব্যক্ত করেছিলেন। সেদিন বয়োবৃদ্ধ সাহিত্যবিশারদঅনেক কথার মধ্যে বলেছিলেন, 'সর্বমানবের সংস্কৃতি আপনারা গড়ে তুলুন। ... চার শত বছরের সংস্কৃতির সম্পদে আজ আপনারা ঐশ্বর্যশালী।' পরবর্তীকালে প্রাবন্ধিক বদরুদ্দীন উমর এই অশীতিপর মনীষীর ভাষণটির কথা উল্লেখ করে লিখেছেন, 'চট্টগ্রাম সংস্কৃতি সম্মেলনের পর থেকে পূর্ব বাংলায় বিশ বৎসর কাল ধরে যে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের বিকাশ ঘটে, আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের এই অভিভাষণকে সেই আন্দোলনের ঘোষণা বললে বিন্দুমাত্র অত্যুক্তি হয় না।'
সাংস্কৃতিক স্বাধিকার আন্দোলন
ষাটের দশকটি শুরু হয়েছে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী (১৯৬১) দিয়ে। আইয়ুবের সামরিক শাসনের সব বাধা ও রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে ঢাকা ও চট্টগ্রামে সপ্তাহব্যাপী অনুষ্ঠান হয়েছে। বিভিন্ন জেলা শহরেও উপলক্ষটি আন্তরিকতার সঙ্গে উদ্যাপিত হয়েছিল। এসব অনুষ্ঠানে যেমন কবি গান, কবিতা, নৃত্যনাট্য, নাটক পরিবেশিত হয়েছে, তেমনি রবীন্দ্রনাথ ও বাঙালি সংস্কৃতি নিয়ে প্রচুর সেমিনারও আয়োজিত হয়েছে। বলা যায়, এরপরে পুরো দশক বাঙালির এই সাংস্কৃতিক জাগরণ ও ব্যাপক অনুশীলনের সূত্রপাত ঘটে। এভাবে দশকব্যাপী চলেছে সাংস্কৃতিক স্বাধিকারের আন্দোলন।
এই আন্দোলনে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে সাংস্কৃতিক সংগঠন ছায়ানট। রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকীর পরেই এটি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়া হয় এবং রবীন্দ্রসংগীতসহ বাংলা প্রমিত গান চর্চা ও এর ভিত্তিতে বছরে নানা অনুষ্ঠান আয়োজনের লক্ষ্যে ১৯৬৩ সালে সংগঠনটি কাজ শুরু করে। এ উদ্যোগে সেকালের প্রগতিশীল অনেক মানুষ যুক্ত হলেও এর লক্ষ্যাদর্শ নির্ধারণ এবং সে অনুযায়ী পরিচালনায় মূল ভূমিকা পালন করেছেন সাংবাদিক ওয়াহিদুল হক ও ড. সান্ন্জীদা খাতুন। পরে ছায়ানট রমনার বটমূলে নববর্ষের প্রভাতি অনুষ্ঠান শুরু করে। অনেক জেলায় আগে থেকেই নববর্ষ উদ্যাপিত হলেও এবার যেন জাতীয়ভাবে সর্বত্র একই লক্ষ্যাদর্শে এ দিনটি উদ্যাপন শুরু হয়। আরও পরে তৎকালীন চারুকলা ইনস্টিটিউট (বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ) থেকে চালু হয় মঙ্গল শোভাযাত্রা। সাম্প্রতিক কালে এটি বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে ইউনেসকের স্বীকৃতি পেয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পঞ্চাশের দশকেই প্রগতিশীল লেখক-শিল্পী- শিক্ষার্থীরা মিলে গঠন করেছিলেন সংস্কৃতি সংসদ। এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তৎকালীন কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, কথাসাহিত্যিক ও চলচ্চিত্রকার জহির রায়হান, শিক্ষাবিদ আনিসুজ্জামানসহ অনেকেই। পরবর্তীকালেও অগ্রসর সৃজনশীল ছাত্রছাত্রীরাই এতে যুক্ত হয়েছেন। ষাটের দশক জুড়ে সংস্কৃতি সংসদ, ডাকসু (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগসহ শিক্ষার্থীদের নানা সংগঠন সক্রিয় ভূমিকা পালন করে গেছে। বাফা বা বুলবুল ললিতকলা একাডেমিও এই সময়ে সংগীতে-নৃত্যে দেশে প্রাণবন্ত সাংস্কৃতিক আবহ তৈরিতে ভূমিকা রেখেছিল। এই দশক জুড়ে সারা দেশের স্কুল-কলেজেও রবীন্দ্র-নজরুল জয়ন্তী উদ্যাপনের
একট ধারা তৈরি হয়। এর ফলে প্রায় ঘরে ঘরে বাঙালি সংস্কৃতি চর্চার প্রসার ঘটেছিল। এ সময় বিভিন্ন উপলক্ষে রাজধানীতে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা হয়েছে, যাতে কবি সুফিয়া কামাল, শিল্পী জয়নুল আবেদিনসহ অনেকেই অংশ নিয়েছেন। শিল্পী কামরুল হাসান বর্ণমালা শাড়ি তৈরিসহ আমাদের লোকজ ঐতিহ্যের অনেক মোটিফ ব্যবহার করে নানা পোশাক ও সামগ্রী তৈরি করেন। এই সাংস্কৃতিক আন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগ করেছিলো রবীন্দ্র- নজরুল ছাড়াও বাংলা গানের চিরায়ত ভান্ডার থেকে আরও গুনী সংগীতজ্ঞদের গান পরিবেশনের ফলে। এভাবে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, রজনীকান্ত সেন, অতুলপ্রসাদ সেনের মতো বাংলা গানের অমর স্রষ্টাদের সঙ্গে সাধারণ শ্রোতাদের পরিচয় ঘটে। রাজনৈতিক আন্দোলনের প্রভাবও পড়েছে সাংস্কৃতিক অঙ্গনে। এ সময় বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনসহ ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে সৃষ্ট অনুপ্রেরণাদায়ী জাগরণের গান পরিবেশনেও অনেকে আগ্রহী হয়ে উঠেছিল। ব্রতচারীর গান ও চর্চা যেমন বেড়েছে, তেমনি পরিবেশিত হয়েছে গণনাট্য সংঘের গান। এভাবে মুকুন্দ দাস, গুরুসদয় দত্ত বা গীতিকার জসীমউদ্দীনের সঙ্গেও সাধারণ শ্রোতাদের পরিচয় ঘটেছে। ক্রমে এই গণসংগীতের ভান্ডারে আমাদের দেশীয় শিল্পীদের অবদানও বাড়তে থাকে। শিল্পী আবদুল লতিফ, শেখ লুৎফুর রহমান, অজিত রায়, সুরকার আলতাফ মাহমুদসহ অনেকের অবদানে গণসংগীতের সমৃদ্ধ ধারা গড়ে ওঠে। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়ও এই ধারা অব্যাহত ছিল।
এভাবে ষাটের দশকের বাঁকবদলের রাজনীতির সঙ্গে একযোগে সংগ্রামী ভূমিকায় ছিল সাংস্কৃতিক অঙ্গন। জাতীয় জাগরণের লক্ষ্যে দশক জুড়ে পরিচালিত এই ধারাবাহিক সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের কারণেই একে সাংস্কৃতিক স্বাধিকার আন্দোলন হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।
আমরা বাঙালি হিসেবে আমাদের পরিচয় কীভাবে গড়ে উঠেছে সে সম্পর্কে জানলাম। তার পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের আচরণিক রীতি নির্ণয় করব।
আমাদের দেশ বাংলাদেশ। এর একটি মানচিত্র আছে যা একটি ভৌগোলিক সীমারেখাকে প্রদর্শন করে। বাংলাদেশের অভ্যুদয় হয়েছে হাজার বছরের বিভিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে। একসময় এটি ভারতবর্ষের অংশ ছিল। বিভিন্ন রাজা, মহারাজা, সম্রাট এদেশে এসেছেন এবং রাজ্য বিস্তার করেছেন। এভাবে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর আগমন এবং মিশ্রণ হয়েছে। এদেশটির স্বাধীনতার পেছনে রয়েছে লক্ষ্য মানুষের আত্মদান। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নিয়ন্ত্রণে আসার পর থেকে এদেশের মানুষ শোষিত হয়েছে চরমভাবে। এরপর পাকিস্তানিদের দ্বারা নানাভাবে নির্যাতনের শিকার। প্রথম তারা আমাদের ভাষার উপর আঘাত হানল। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে শহিদ হন এদেশের মাটিতে বেড়ে ওঠা রফিক, শফিক, বরকত, জব্বারসহ আরও অনেকে। এই শহিদদের রক্তের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি আমাদের মাতৃভাষা। কালক্রমে নানা ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের মধ্য দিয়ে রূপ লাভ করা আমাদের বাংলা ভাষাও আমাদের প্রকৃতি ও সংস্কৃতির এক অনবদ্য অংশ। এরপর আমরা বারবার সোচ্চার হয়েছি পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে আমাদের নাগরিক ও মানবিক অধিকার নিয়ে। আর এই জাতিকে বলিষ্ঠভাবে নেতৃত্ব দিয়েছেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর নেতৃত্বে প্রায় ৯ মাস যুদ্ধের পর আমরা পেয়েছি আমাদের প্রিয় পতাকা ও একটি স্বাধীন মানচিত্র।
অনুশীলনী কাজ ৫: চলো, বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে ভৌগোলিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে আমরা নিজেদের আত্মপরিচয় নির্ণয় করি। |
আমরা বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে একটি পরিচয় বহন করি। এই দেশের মানুষ হিসেবে আমাদের আচরণগত কিছু সাদৃশ্য রয়েছে। আমাদের রীতিনীতি, মূল্যবোধ, আচরণ, ভাষা, খাবার ইত্যাদিতে মিল আছে। কিন্তু আমরা যদি খেয়াল করি, তাহলে দেখব আমাদের দেশের সব অঞ্চলের মানুষের আচরণিক বৈশিষ্ট্য এক নয়। আমাদের ভৌগোলিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে রয়েছে ভিন্নতা। যেমন: সিলেটের হাওর অঞ্চলের মানুষদের জীবনযাপনের সঙ্গে পাহাড়ি অঞ্চলের মানুষের জীবনযাপনে ভিন্নতা রয়েছে। শুধু তা-ই নয়, ভূ-প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যের ভিন্নতার কারণে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের গান, কবিতা ও গল্পেও ভিন্নতা দেখতে পাই। যেমন: সিলেটের হাসন রাজার গান, নদী বিধৌত বাংলার ভাটিয়ালি গান, উত্তরবঙ্গের ভাওয়াইয়া গান ইত্যাদি বিভিন্ন অঞ্চলের গানের বৈশিষ্ট্য ও সুরে রয়েছে ভূ-প্রকৃতির প্রভাব। উদাহরণস্বরূপ ভাওয়াইয়া গানের সুরে রয়েছে ভাঁজ। কারণ, উঁচু নিচু, ভাঙা রাস্তার উপর দিয়ে গরুর গাড়িতে বসে গায়েন যখন সুর ধরতেন তার গলার কাঁপুনিতে ভাজ পড়ত। এভাবেই ভাওয়াইয়া গানগুলো হয়ে ওঠে বৈশিষ্ট্যময়। অন্যদিকে সিলেট অঞ্চলের মানুষের মুখের ভাষার সঙ্গে চট্টগ্রাম অঞ্চলের মানুষের মুখের ভাষায় রয়েছে ভিন্নতা। তাছাড়া এদেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের • রয়েছে নিজস্ব ভাষা, পোশাক, রীতিনীতি, উৎসব উদ্যাপনের সংস্কৃতি। এভাবেই কোনো দেশের একটি নির্দিষ্ট - অঞ্চলের মানুষের আচরণগত বৈশিষ্ট্যের সাদৃশ্যে গড়ে ওঠে একটি আচরণিক রীতি।
দলগত কাজ ২ এখন আমরা আগের দলে বসে যাই। দলের সবাই মিলে বিভিন্ন উৎস থেকে তথ্য নিয়ে নিচের ছকটি পূরণ করি। আমরা বাংলাদেশের চারটি ভূ-প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন অঞ্চলের মানুষের আচরণিক বৈশিষ্ট্য খুঁজে বের করি। এরপর দলে আলোচনা করে আচরনিক রীতি লিখি। |
দলগত কাজ ৩ এখন আমরা নিজ এলাকার মানুষের ভৌগোলিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে আচরণিক রীতি বৈজ্ঞানিকভাবে অনুসন্ধান করব। এই কাজটি আমরা দলগতভাবে করব। এই কাজটি করার জন্য আমরা একই এলাকার সহপাঠীদের নিয়ে ৫-৬ জনের একটি দল গঠন করব। এরপর আমরা বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের ধাপগুলো অনুসরণ করে তথ্য সংগ্রহ করব। |
তথ্য সংগ্রহের নমুনা প্রশ্ন: ১. আপনার জন্মস্থান কোথায়? ২. আপনার পূর্বপুরুষ কোথায় থাকেন? ৩. আপনি পরিবারে কোন ভাষায় কথা বলেন? ৪. আপনার পরিবারের প্রধান খাবার কী? . . . . . .. . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . • প্রশ্ন উত্তরের মাধ্যমে প্রাপ্ততথ্য বিশ্লেষণের মাধ্যমে নিজ এলাকার মানুষের আচরণিক বৈশিষ্ট্যের সাদৃশ্যের ভিত্তিতে আচরণিক রীতি নির্ণয় করি।
|
প্যানেল আলোচনা আয়োজন
আমরা একটি প্যানেল আলোচনার আয়োজন করি। প্রতিটি দল আমাদের অনুসন্ধান থেকে প্রাপ্ত নিজ এলাকার মানুষের আচরণিক রীতি প্যানেল আলোচনায় উপস্থাপন করব। এ জন্য আমরা ছবি, পোস্টার পেপার, পাওয়ার পয়েন্ট ইত্যাদি ব্যবহার করতে পারি।
আরও দেখুন...